দুপুর ২টা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিচ তলা। ক্যানসার বিভাগ, ১০৩ নম্বর ওয়ার্ড। ৯ নম্বর বিছানায় বসে কথা হয় মোছা. সোমা আক্তারের সঙ্গে। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ থানার বাকুরপুর গ্রামের বাসিন্দা ৩৬ বছর বয়সি সোমা। সোমা বলেন, ‘১০/১১ বছর বয়সে বাবা মারা যান। একটু বড় হলে, অভাবের সংসারে হাল ধরতে গার্মেন্টে কাজে যোগ দেই নরসিংদীতে। এরপর একে একে ছোট চার বোনের বিয়ে দিয়েছি, মা ও নিজের খাওয়া পরার খরচ যোগাতে নিজের বিয়ে করা হয় নাই। বলেন, একবারকার জ্বরের মইধ্যে লক্ষ করি ডান স্তন শক্ত হয়ে গেছে। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি ঢাকায় সরকারি হাসপাতালে দেখাতে বলেন, কিন্তু অভাবি সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ডাক্তার দেখার সময় করে উঠতে পারি নাই। পরে সাত মাস পর স্তনে প্রচণ্ড ব্যথা, সাথে জ্বর এলে ডাক্তারের কাছে যাই, তখন ডান স্তনে চারটা মুখ পেকে পুঁজ বের হচ্ছিল। উপজেলার ঐ ডাক্তার দ্রুত হাসপাতালে আসতে বলেন। এখন এই হাসপাতালে ডান স্তন কেটে ফেলা হয়েছে। সোমা বলেন, আমার দুই স্তনে চাকা আছে। কিন্তু একবারে দুইটা অপারেশন করা যাবে না বলে একটা করে দিয়েছে। এখন ক্যামোথ্যারাপি চলছে। ডান বুকের কাটা শুকালে বাম স্তন অপারেশন হবে বলেন জানান।
অজ্ঞতা ও অসচেতনতায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা বাড়ছে। নিজে নিজের স্তন পরীক্ষার ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএআরসিয়ের তথ্য মতে, প্রতি বছর নতুন করে ১৩ হাজার নারী এই ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর বছরে মারা যান প্রায় ৮ হাজার নারী। বর্তমান বিশ্বে নারীদের অন্যতম প্রধান ক্যানসার হলো স্তন ক্যানসার। বিশ্বে প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি নারী এই রোগে আক্রান্ত হন। আর মারা যান প্রায় ৭ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমারে পরিণত হয়। সেটি রক্তনালির লসিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যানসার। চলছে স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস। অক্টোবর মাস জুড়েই স্তন ক্যানসার বিষয়ে সচেতন করতে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
রাজশাহী ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার স্ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক ডা. পেট্রিক বিপুল বিশ্বাস ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের হাসপাতালে যত রোগী আসে তার ৯০ ভাগ স্তন ক্যানসার আক্রন্ত রোগী। তারা যে অবস্থায় আসে, তাদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ ভাগ হয়তো বা কোনো একটা স্টেইজে থাকে; বাকিগুলোর অধিকাংশই সাংঘাতিক অ্যাডভানস স্টেইজে আসে। তিনি বলেন, প্রথমত তারা হয়তো বুঝতে পারেন না, যখন বুঝতে পারেন তখন হয়তো কিছুটা ব্যথা থাকে; হ্যাসবেন্ডকে বলেন, সে হয়তো খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। যখন বেশি ব্যথা বা টিউমার হয়, তখন হয়তো ওয়াইফকে নিয়ে যান একজন জেনারেল ডাক্তারের কাছে। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের গোটা বাংলাদেশে ১৩০ জন ক্যানসার স্পেশালিস্ট আছেন। তিনি কিছু চিকিত্সা দেন, টাকা-পয়সা খরচ করে তারপর চলে যান, কিন্তু ভালো কিছু হয় না। এভাবে সময়ক্ষেপণ করে টাকা-পয়সা শেষ করে শেষে আমরা পাই। সচেতনতার অভাব আর আর্থিক কিছু সমস্যা দেরিতে চিকিত্সা নিতে আসার কারণ বলে জানান। তবে সচেতনতার অভাবটাই মেইন। দ্বিতীয়ত ক্যানসার শনাক্তের সুযোগ-সুবিধা খুব কম।
ডা. পেট্রিক বিপুল বিশ্বাস বলেন, আমরা স্তন ক্যানসার দিবসকে ঘিরে এক দিনের জন্যে বিনা পয়সায় দিলাম—বিষয়টা এমন না। আমাদের হাসপাতাল অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে মিনিমাম একটা চার্জ আমরা নেই। সেই চার্জ যদি কেউ দিতে না পারে, তখন তাকে আমরা বিনা মূল্যেই সেবা দিয়ে থাকি। এটাই আমাদের প্রধান লক্ষ।
বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, একটু সচেতন থাকলেই এই ব্যাধিকে প্রতিরোধ করা যায়। ঝুঁকিতে থাকা এই ৯ শ্রেণির নারী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজে এ বিপদ এড়িয়ে চলতে পারেন। ৩৫ বছরের ওপরের নারীরা ম্যারেনাগ্রাফিক স্ক্রিনিং করে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। ২০ বছর বয়স থেকেই নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিত্সকরা।
সচেতনতাই পারে এই রোগ প্রতিরোধ করতেঃ
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি, লালমাটিয়া কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার, মাসব্যাপী বিনা মূল্যে নারী চিকিত্সক দিয়ে স্তন স্ক্রিনিং চলবে। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্বল্প খরচে সবধরনের পরীক্ষা ও অতি দরিদ্র রোগীদের মাত্র ৫ হাজার টাকায় অপারেশন করানোর সুযোগ রেখেছে মাসব্যাপী।